নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এটি স্লোগান নয়; বাস্তবতা। চট্টগ্রাম বন্দর যখন থেমে যায় তখন বাংলাদেশ থেমে যায়। গত ১৪ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি বলে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মা সেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল নির্মাণের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। ২০০৮ সালে ছিল ৬০তম স্থানে। ১৪ বছরে ৩৫ তম স্থানে উন্নয়নে অধিকাংশ কৃতিত্বের অধিকারী চট্টগ্রাম বন্দর। গত ১৪ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটি-১ এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জেটিতে সর্বপ্রথম ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজের বার্থিং এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন (Robert Chatterton Dickson), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মোস্তফা কামাল, চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো: আরিফ এবং কর্ণফুলী রিভার স্টাডি কনসালটেন্ট এইচ আর ওয়ালিংফোর্ড এর বাংলাদেশের পার্টনার ইন্টারপোর্টের পরিচালক ড. মঞ্জুরুল হক, শিপিং এজেন্ট এসোশিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ হোসেন, বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
২০০ মিটার দৈর্ঘের বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়লে জাহাজে কন্টেইনারের পরিমাণ বাড়বে ও পণ্য পরিবহন খরচ কমবে। ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম কমে সুফল পাবে সাধারণ মানুষ। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৬,৬৫০টি জাহাজ ভিড়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের ৯৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে; দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি চালু করা হবে। ২০২৪ সালে বে-টার্মিনাল চালু করার কথা থাকলেও করোনা মহামারি এবং বৈশ্বিক দুর্যোগ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বহুবিধ সমস্যায় আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বসে নাই। আমাদের সক্ষমতা আছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বে-টার্মিনালের বৃহৎ অংশ মাল্টিপারপাস টার্মিনাল যেটি চট্টগ্রাম বন্দর করবে সেটির ডিটেইল প্লান তৈরি হচ্ছে। ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে বে-টার্মিনালের বৃহৎ অংশ মাল্টিপারপাস টার্মিনাল যেটি চট্টগ্রাম বন্দর করবে সেটি চালু করতে সক্ষম হব। মাতারবাড়ী বন্দর ২০২৬ সালের মাঝামাঝি অথবা শেষের দিকে চালু করতে পারব।
তিনি বলেন, অনেকে বলেছেন বাংলাদেশ শ্রীলংকার মতো হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। কেন হলোনা-এটা অনেকের মনে কষ্ট হচ্ছে। আগে বাংলাদেশ বাজেট তৈরির জন্য বিদেশীদের কাছে যেতে হতো। এখন দাতাগোষ্ঠী আমাদের পিছনে হাটছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। এখন আর আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি নই; সেটি মিথ্যা প্রমাণিত। ২০৩০ সালে অর্থনৈতিক সূচকে ২৫-৩০ এর মধ্যে চলে যাব। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশের মাটি ও মানুষকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ করেছি। বাংলাদেশ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়; আঞ্চলিক দেশগুলোর ছন্য তৈরি হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ অপেক্ষা করছে। সমগ্র পৃথিবীর বিনিয়োগকারিরা বাংলাদেশে আসবে। এজন্য দরকার স্থিতিশীলতা। গত ১৪ বছরে স্থিতিশীলতা আছে বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়। সেটি সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা যে উন্নয়ন করেছেন; দেশের মানুষকে যে সম্মান দিয়েছেন; সেখানে দেশের মানুষ শেখ হাসিনার বিকল্প অন্য কিছু ভাবছেনা। আগামী নির্বাচনে আরো বেশি সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করবে। কোন বিদেশী চাপে পিছিয়ে যাবেনা। দেশের মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাবে।
প্রতিমন্ত্রী এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের ভান্ডার ভবন এলাকায় নবনির্মিত 'চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রীয় ভান্ডার' উদ্বোধন করেন। ৭১ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ভান্ডারের মোট প্রজেক্ট এরিয়া ৫১,০০০ বর্গফুট।
গেস্ট অব অনার ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, এটি চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন। ২০০ মিটার লম্বা বড় জাহাজ ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর ফলে বাংলাদেশের আমদানি রফতানিতে আরও গতি আসবে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, করোনাকালে ৫৪ জন লোক মারা গেছে কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ হয়নি। দেশের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছেন। সরকারের শেষ বছর। তখন বিভিন্ন দাবি, উস্কানি শুরু হয়। সাপ্লাই চেইন সবার জন্য। বে টার্মিনাল করতে যাচ্ছি। আমরা একদিনের জন্যও কাজ থামাইনি। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে স্মার্ট। পোর্টও হবে স্মার্ট। এর জন্য স্মার্ট টিম চাই। মাতারবাড়ী, বে টার্মিনাল, চট্টগ্রাম বন্দর একসঙ্গে অপারেশন করলে জাতীয় আয় বাড়বে।
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, আজ বন্দরের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ২০০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ‘কমন অ্যাটলাস’ ভিড়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বন্দরকে মাইনমুক্ত করে চালু করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী সমুদ্রসীমা জয় করেছেন। বে টার্মিনাল জাতির চাহিদা। ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। করোনার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। ত্রি মিলিয়ন কনটেইনার ক্লাবে অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। বন্দর ব্যবহারকারী ও দেশকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে আমরা সচেষ্ট। বাংলাদেশের জাহাজ মালিকরা বড় বড় জাহাজ নিয়ে আসছেন। এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। করোনার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর একমুহূর্তও বন্ধ ছিল না। সব কৃতিত্বের মূল দাবিদার আমাদের শ্রমিকরা। করোনার মধ্যে তাদের মুখে না শুনিনি।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক হাইড্রোলিক সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ডের প্রতিনিধি ড. মনজুরুল কাদের বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এ স্টাডি ছিল চ্যালেঞ্জিং। করোনার কারণে এটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল। আজ বড় জাহাজ ভিড়েছে এটিই বাস্তবতা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, বহির্নোঙরে যে কার্গো লাইটারিং হয় সেই জাহাজগুলোকে এ সুবিধা দিলে ৪০-৪৫ হাজার টন পণ্য আনতে পারবে। গুপ্ত খাল খনন করা হলে আরও বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে আমাদের যে চুক্তি করতে হয় তার আর প্রয়োজন হবে না। বড় জাহাজের পাশাপাশি ছোট ফিডার জাহাজ বার্থিংয়ের সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে। কনটেইনার জাহাজের পাশাপাশি বাল্ক জাহাজকেও সুবিধা দিতে হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নব্বই দশক ও এর আগে অনেক দুঃসময় কাটিয়েছিল। গত ১৪ বছর একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি এ বন্দর। করোনাকালেও এ বন্দর এক ঘণ্টার জন্যেও বন্ধ ছিল না। এনসিটি তৈরির পর চার বছর কাজ হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর চার মিলিয়ন কনটেইনার ক্লাবে যাবে আশা করি। পিসিটি তৈরি আছে, যত তাড়াতাড়ি চালু হয় তত মঙ্গল।
কর্ণফুলী নদী বন্দরের প্রাণ। এ বন্দর সচল রাখতে কর্ণফুলী ড্রেজিং চালু রাখতে হবে। মামলাও থাকবে-হামলাও থাকবে, ড্রেজিং বন্ধ করা যাবে না। বে টার্মিনালের কাজ কখন শুরু হবে নৌ প্রতিমন্ত্রীর মুখে শুনতে চাই। বে-টার্মিনাল হলে বাংলাদেশকে ৫০ বছর বন্দর নিয়ে ভাবতে হবে না।
এ অবস্থায় কর্ণফুলী নদীর মোহনা হয়ে বন্দরের জেটিতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গভীরতা সৃষ্টি করে বড় আকারের জাহাজ ঢোকার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এসব জাহাজে ৪ হাজারের বেশি কনটেইনার পরিবহন সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, প্রত্যেকটি জাহাজের দৈনিক পরিচালন ব্যয়বাবদ ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার গুনতে হয়। আমাদের এ পদক্ষেপে সেটি কমে যাবে। জাহাজের সংখ্যা কমে গেলে, আমাদের জন্য জাহাজ পরিচালনা করাও সহজ হবে।
১৯৭৫ সালে এই বন্দরে মাত্র সাড়ে ৭ মিটার গভীরতা এবং ১৬০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ প্রবেশের সুযোগ পেত। পরবর্তীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ১৯৮০ সালে ৮ মিটার গভীর, ১৭০ মিটার দীর্ঘ; ১৯৯০ সালে সাড়ে ৮ মিটার গভীর, ১৮০ মিটার দীর্ঘ; ১৯৯৫ সালে ৯ মিটার গভীর ১৮৫ মিটার দীর্ঘ এবং ২০১৪ সালে সাড়ে ৯ মিটার গভীর ও ১৯০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
সর্বশেষ ক্যাপিটেল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজের প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণ আকৃতির তুলনায় ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজগুলো দ্বিগুণের বেশি কনটেইনার বহনের সক্ষমতা রয়েছে। ফলে বড় জাহাজ দিয়ে আমদানি কিংবা রফতানি করা গেলে খরচও যেমন কমে আসবে, তেমনি জাহাজ বহির্নোঙ্গরে অবস্থান না নিয়ে বন্দরের প্রধান জেটিতে প্রবেশ করতে পারবে। এতে গড় অবস্থানকালীনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
চট্টগ্রাম বন্দর এবং বহির্নোঙ্গরে প্রতি বছর ৪ হাজারের বেশি পণ্যবাহী জাহাজ আসছে। এসব জাহাজে ৩২ লাখ কনটেইনার এবং ১১ কোটি মেট্রিক টন কার্গো পণ্য আসে