তথ্য প্রাপ্তির অধিকার বাধাগ্রস্ত করে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি বা গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা মানবাধিকারের ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন। এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রোববার (২৩ জুলাই) সকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। ইন্টারনেট-শাটডাউনসহ সকল ধরনের ডিজিটাল-নির্যাতনের প্রতিবাদে বিএনপির মিডিয়া সেল এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
অবিলম্বে গণবিরোধী ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষের বাস্তব জীবনে যে অধিকার আছে, অনলাইনেও সেই একই অধিকার বলবৎ আছে। আজ অধিকাংশ মানুষ তার চিন্তা ভাবনাকে অনলাইনের মাধ্যমেই প্রকাশ করে থাকেন। বাস্তব জীবনে মানুষের গোপনীয়তা রক্ষার যে অধিকার আছে অনলাইনেও সেই গোপনীয়তা রক্ষা করার অধিকার তার রয়েছে। তাই ডিজিটাল-অধিকারকে লঙ্ঘন করে তার তথ্য প্রাপ্তির অধিকার বাধাগ্রস্ত করা, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি বা গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা মানবাধিকারের ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশ-বিদেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির সহযোগিতায় বাংলাদেশে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন আজ জনগণের স্বস্তস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালার পর্বে অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছে। এতদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন, জেল-জুলুম, নির্যাতন, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা- মামলাসহ বিভিন্ন রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে দমন করার অপচেষ্টা করেছে। তাদের সমস্ত অপচেষ্টাই প্রায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আন্দোলন সংগ্রামের এই তথ্য সমূহের অবাধ প্রবাহকে ক্ষমতাসীন সরকার ভয় পায়। ইতোমধ্যেই সে কারণে অনির্বাচিত অবৈধ পার্লামেন্টে তারা তৈরি করেছে গণবিরোধী ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ)। এই গণবিরোধী আইনের বলে ইতোমধ্যে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নয়, মুক্তমনা অনেক সাংবাদিক ও স্বাধীন নাগরিকরাও শিকার হয়েছেন মিথ্যা মামলার। এতকিছুর পরেও ক্ষমতাসীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের ভয়ে ভীত হয়ে প্রয়োগ করছে নতুন ডিজিটাল অস্ত্র ‘ইন্টারনেট-শাটডাউন’। নির্যাতনকারী পুলিশ কেড়ে নিচ্ছে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত ডিভাইস ‘মোবাইল ফোন’।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, বর্তমান এই জন-বিচ্ছিন্ন, অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট সরকার কথায় কথায় ডিজিটাল বাংলাদেশের কৃতিত্ব দাবি করে থাকে। কিন্তু আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে দেখি তবে দেখা যাবে বাংলাদেশে ডিজিটাল সেবার অবস্থা কত শোচনীয়। বরং সাইবার জগতে মানুষের যেটুকু স্বাভাবিক অধিকার অবশিষ্ট আছে সেই অধিকারকেও কেড়ে নেয়ার গভীর চক্রান্ত করছে এই আওয়ামী লীগ সরকার।
তিনি আরও বলেন, নাগরিকদের সেবা প্রদান এবং তাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করার জন্য দেশে একাধিক প্রতিষ্ঠান আছে। তেমন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিচালনা এবং সেবার মান দেখভাল করা। কিন্তু জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানকেই বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার জনগণের বিরুদ্ধে নিপীড়নের আরেকটি আধুনিক হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়ার মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে জনগণকে, কেড়ে নেয়া হচ্ছে মত প্রকাশের অধিকারকে।
মির্জা ফখরুল বলেন, গত ১২ জুলাই এক দফা দাবিতে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ঐতিহাসিক সমাবেশ চলাকালে ওই এলাকার ইন্টারনেট সুবিধা বিচ্ছিন্ন/বিঘ্নিত করা হয়েছিল। অথচ সেদিন ওই সময়েই সরকারি দলের সমাবেশস্থলের ইন্টারনেট সংযোগ ছিল স্বাভাবিক। একাধিক সংবাদ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউনের এটিই প্রথম ঘটনা নয়। ইতোপূর্বে খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী এবং ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতেও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেশে ও প্রবাসে বসবাসকারী সকল নাগরিকদের তথ্য পাওয়ার অধিকার লংঘন করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ আগ্রহী মহলকে করা হয়েছে বিচ্ছিন্ন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ডিজিটাল-নির্যাতনের এই পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবসানের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে প্রণীত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রুপরেখার ৩০নং দফায় বিএনপির প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ডিজিটাল সেবাকে বিএনপি বৈশ্বিক মানে উন্নীত করবে। সরকার পতনের চলমান একদফা আন্দোলনের সম্পূরক হিসাবে আমরা এই ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক ইন্টারনেট-শাটডাউন, নজরদারি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, মোবাইল ফোন তল্লাশিসহ সকল ধরনের ডিজিটাল- নির্যাতনের অপব্যবহারের সুদৃঢ়ভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। গণবিরোধী ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানাই। এ ধরনের সকল ডিজিটাল-নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশের সব নাগরিকদের আজ ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানাই। দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের সকল ধরনের ডিজিটাল ক্ষমতাকে নাগরিক অধিকার-বান্ধব করে ঢেলে সাজানোর জোর দাবি জানান তিনি।
তিনি বলেন, ইন্টারনেট পরিসেবা আজ শুধু সোস্যাল মিডিয়ার বিনোদনেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা আর্থিক লেন-দেন, শেয়ার, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, ডাটা, আউট সোসিং, বৈদেশিক ভ্রমণ, কর্মসংস্থান ও চাকরি সাক্ষাৎকারসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়ে জীবন জীবিকার এক অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। সাইবার জগতে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ জানানো ও দাবি আদায়ের জন্যে জড়ো হওয়ার মাধ্যম হিসাবেও ইন্টারনেট এখন গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। যা সভা-সমাবেশ করা ও সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার হিসাবে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭ দ্বারা স্বীকৃত। ফলে ইন্টারনেট পরিসেবা নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধের মতো ঘটনাগুলো সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্তির নাগরিক অধিকারের লংঘন।
তিনি আরও বলেন, একদিকে এই অবৈধ সরকার কখনো স্মার্ট বাংলাদেশের নামে সকল রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে নাগরিকদের সাইবার জগতের সকল সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে তাদেরই অযোগ্যতা এবং চরম অদক্ষতার জন্য প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিকের ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে, যা বিদেশের একটি গণমাধ্যমের সূত্রে আমরা সবাই জানতে পেরেছি। সেইসঙ্গে বর্তমান সরকার এই ডিজিটালাইজেশনকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ডিজিটাল মাধ্যমে নিপীড়ন, জনগণের ওপর নজরদারি, ফোন কল রেকর্ড, অনলাইনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, অনলাইনে নারীদের প্রতি সহিংসতাকে উস্কে দেয়া, ভিন্ন মতাবলম্বীদের ব্ল্যাকমেইল করা ও কন্টেন্ট জালিয়াতির মাধ্যমে প্রপাগাণ্ডা চালানোসহ নানান অপরাধ করে চলেছে সরকার।