ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি:
ভবনের সামনে সরকারি খাল ও একটি টয়লেট। পেছনে বিশাল পুকুর। তার ঠিক মাঝখানে একতলা বিশিষ্ট একটি ভবন। প্রথম দেখায় মনে হবে পরিত্যক্ত কোন ভূতুড়ে স্থাপনা। এর পাশ দিয়ে মানুষ যেতেও ভয় পায়। কিন্তু না, জীবনের ঝুঁকি জেনেও এই ভবনেই প্রতিদিন আসছেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপিসহ) স্বাস্থ্য সহকারীরা। নিয়মিত দিচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবাও।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের বেশ কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকের চিত্র এটি। সম্প্রতি ধরমন্ডল ইউনিয়নের দৌলতপুর ও চাপরতলা ইউনিয়নের কালিউতা গ্রামে ঘুরে ক্লিনিকগুলোর এ চরম দুরাবস্থার দৃশ্য চোখে পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা কোনমতে সচল রাখা হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অচিরেই গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে ওই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়া পৌঁছে দিতে ১৯৯৬-২০০০ অর্থবছরে নাসিরনগর উপজেলায় ২২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবন নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ভবন নির্মাণ করা হয় পাঁচশত ভূমির উপর। ভবনগুলো লম্বায় ২৮ফুট ও প্রস্থে ১৬ ফুট। কিন্তু দৌলতপুর ক্লিনিকটির জায়গা দুইশতকও হবে না।
আরো জানা গেছে, এক দশক না যেতেই ৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকের বেহাল দশা বিরাজ করছে। এর মধ্যে তিনটি পরিত্যক্ত অন্যগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। পরিত্যক্ত ক্লিনিক তিনটি হচ্ছে, ধরমন্ডল ইউনিয়নের দৌলতপুর, চাপড়তলা ইউনিয়নের কালিউতা ও গোয়ালনগর ইউনিয়নের কদমতলী।
ঝুঁকিপূর্ণ ক্লিনিক হচ্ছে- ভলাকুট ইউনিয়নের খাগালিয়া, গোকর্ণ ইউনিয়নের জেঠাগ্রাম ও নূরপুর, পূর্বভাগ ইউনিয়নের নরহা, হরিপুর ইউনিয়নের আলিয়ারা ও ধরমন্ডল ইউনিয়নের ধরমন্ডল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনায় ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য একজন করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আছেন। এসব ক্লিনিকে প্রসূতি মায়েদের প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা দেওয়াসহ জরুরীভিত্তিতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সিএইচসিপিদের সহযোগিতা করার জন্য স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী সপ্তাহের তিন দিন ক্লিনিকে উপস্থিত থাকেন। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কদমতী, দৌলতপুর ও কালিউতা ক্লিনিক ভবনগুলোর দেওয়ালের চারপাশে ফাটল। ভবনের পেছনের ওয়াল ভেঙ্গে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দরজা-জানালাও ভাঙ্গা। ক্লিনিকের ভবনের একপাশ ভেঙ্গে গেছে, ছাদ থেকে পলেস্তেরা খসে খসে পড়ছে। বেশ কয়েকবার মাথার উপর পলেস্তেরা পড়ে আহত হয়েছেন রোগীসহ সিএইচসিপিরা। ভেতরে ময়লার স্তুপ।
নেই বিদ্যুৎ, পানি ও পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। এ যেন ভূতুরে একটি ঘর। শুধু মানুষ কেন, কোন জীবজন্তুও ঝুঁকি নিয়ে এই ভবনগুলোতে থাকতে চাইবে না। এতকিছুর পরও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ওই ক্লিনিকগুলোর সিএইচসিপিরা ভাড়া ঘরে সেবা দেওয়ার কথা বললে কর্তৃপক্ষ ভাড়ার টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই চাকরি বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি জেনেও সেবা দিয়ে যাচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে।
দৌলতপুর ক্লিনিকের সিএইচসিপি তাহমিনা আক্তার বলেন, তিন-চার বছর ধরে ক্লিনিকের পেছনের অংশের মাটি সরে গিয়ে ভবনটি এখন মৃত্যুকুপে পরিণত হয়েছে। যে কোন সময় পুরো ভবনটি ভেঙ্গে গিয়ে প্রাণহানি হতে পারে। ভবনের ভেতরে নেই বিদ্যুৎ, পানি ও পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। ইচ্ছা না থাকলে চাকরির জন্য কেবল জীবনের ঝুঁকি জেনেও কাজ করতে হচ্ছে। কালিউতা ক্লিনিকের সিএইচসিপি শামছুন্নাহার বলেন, আমার এলাকার ক্লিনিকের ভবনের একপাশ ভেঙ্গে গেছে। গত দুই বছর ধরে ভবনটিতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। ভাড়া নিয়ে কাজ চালিয়ে যাব সেই নিদের্শও দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। আমরাওতো মানুষ, চাকরী করি বলে কি আমাদের জীবনের কোন দাম নেই! তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, পরিবার পরিজনের জন্য ঝুঁকি জেনেও চাকরিটা করছি। তা না হলে কোন সুস্থ মানুষ এই ভবনে গিয়ে চাকরির দায়িত্ব পালন করবে না।
দৌলতপুর গ্রামের কোনাপাড়া মক্তবের ইমাম মো. আক্তার মিয়া বলেন, যে স্থানে কমিউনিটি ক্লিনিকটি করা হয়েছে তার দুই দিকে পানি। সামনে স্থানীয়দের টয়লেট। বাকী দুই দিকে নেই কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার পরও মানুষ কষ্ট করে চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু এই ক্লিনিকটি যে কোন সময় ভেঙ্গে প্রাণহানি হতে পারে। এ ব্যাপারে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.অভিজিৎ রায় বলেন, যেসব কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত সেগুলো নতুনভাবে নির্মাণ করার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে। আশা করছি অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে।