আগস্ট আমাদের শোকের মাস। ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। এটা অভূতপূর্ব, অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিয়োগান্ত। আমরা আগে ছিলাম পাকিস্তানি। এখন বাংলাদেশি। আমাদের পাকিস্তানবিরোধী রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে আছে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও দ্রোহ। পাকিস্তানে নিয়মিত বিরতিতে জারি হয় কোটালের রাজ। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশেও এ রকম দেখেছি তিনবার। ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালে। এই সব কটির মধ্যে ব্যতিক্রম হলো ১৯৭৫। অন্য সব অভ্যুত্থান ছিল ‘রক্তপাতহীন’। ১৯৭৫ ছিল রক্তাক্ত। কেন এমন হলো?
১৫ আগস্ট নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া হচ্ছে। আরও হবে। ৫২ বছর হয়ে গেল। অনেক কিছুই জানা গেল না। বলা হয়ে থাকে, এটা শুধু ‘কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার’ কাজ নয়, এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। সেই ষড়যন্ত্রটি আজও উন্মোচন করা গেল না।
এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে, সে সময়ের সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। খুনিদের সঙ্গে সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে ১৫ আগস্টের ৯ দিন পরই জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। এর পর জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতিসহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন এই জিয়াউর রহমান।
১৫ আগস্ট নিয়ে হাতের কাছে আছে দুটি বই, লরেন্স লিফশুলৎজের দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন আর অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দ্য লিগ্যাসি অব ব্লাড। দুটো বইকে অভ্রান্ত ধরে নিয়ে মন্তব্য করতে থাকলে তো আর অনুসন্ধানের দরকার পড়ে না। ১৫ আগস্ট ও তার পরপর আমরা দেখেছি কয়েকজন মেজর-ক্যাপ্টেন বঙ্গভবনে বসে ছড়ি ঘোরাত। তাদের নেতা ছিলেন রশিদ আর ফারুক। মসনদে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ। তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হন জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। তার নিচেই ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। এটা অনুমিতই ছিল যে মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে নতুন একজনকে সেনাপ্রধান করা হবে। এটি করতে ৯ দিন লেগে গেল। সেনাপ্রধান হিসেবে মোশতাক, ওসমানী, রশিদ ও ফারুকের প্রথম পছন্দ ছিলেন খালেদ মোশাররফ। ওসমানী জিয়াউর রহমানকে খুব অপছন্দ করতেন। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীদের বেশির ভাগের পছন্দ হিসেবে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ঘাতক মেজর ডালিম ভোর ৬টার দিকে বেতার ঘোষণায় জানায়, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। সকাল প্রায় ৮টায় খোন্দকার মোশতাক বেতারে প্রদত্ত ভাষণে বলেন- “তার উপর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।” জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্যদের লাশ ধানমন্ডির বাড়িতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যোগদান করে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান এবং বিডিআর, পুলিশ, রক্ষী বাহিনী প্রধানরা পৃথকভাবে বেতারে খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহকর্মী ও মন্ত্রীদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই ঘাতক সরকারের মন্ত্রী হন। সেনাবাহিনী প্রধান কে এম সফিউল্লাহ ও উপপ্রধান জিয়াউর রহমান দু’জনকেই বঙ্গবন্ধু স্বল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি প্রমোশন দিয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল বানিয়ে সেনাপ্রধান ও উপপ্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে অদ্যাবধি কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া না গেলেও হত্যাকাণ্ডের পর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। অবশ্য তিনি গত সাড়ে চার দশকে বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছেন- তার পদস্থ সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিলেন আবার কেউবা প্রতিরোধের ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেনি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যার ১০ দিনের মাথায় সফিউল্লাহকে সরিয়েও দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র খুবই উল্লসিত হয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রবীণ জননেতা মওলানা ভাসানী সর্বাগ্রে ঘাতক মোশতাক সরকারকে সমর্থন দেন। তথাকথিত রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরিত তারবার্তায় নতুন সরকারের প্রতি অভিনন্দন ও তার পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান। মওলানা এই পরিবর্তনকে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে দেশ হতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অবিচার দূর করার আহ্বান জানান। (ইত্তেফাক, ১৭.৮.১৯৭৫)
যেই রক্ষীবাহিনীর জন্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর অনেকের ক্ষোভ ছিল, সেই রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি গুলিও ছোড়েনি। এখানে উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট সকালে সশস্ত্র ডালিমচক্র সেনাপ্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে যেতে এলে সেনাপ্রধান প্রতিরোধের আশায় ৪৬ ব্রিগেডে যান। সেখানে গিয়ে দেখলেন, জনৈক ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি পদতলে পিষ্ট করছে আর জোয়ানরা সরকার পতনে উল্লাস করছে।
হয়তো কেউ বলবেন, বঙ্গবন্ধুর লাশ বত্রিশ নম্বরে- রাস্তায় সশস্ত্র আর্মি, ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘাতকের মহড়া, এর মধ্যে কীভাবে প্রতিরোধের ডাক দেয়া সম্ভব। তবে এটাও ঠিক রাজধানী ছাড়া সারা বাংলাদেশে কিন্তু আর্মি বা ট্যাঙ্কের মহড়া ছিল না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আর্মির হত্যাকারী ওই ক্ষুদ্র অংশ ভয়ে ভয়ে ছিল। ওরা ঊর্ধ্বতনদের বলছিল- ‘আমরা দেশের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা পরিস্থিতি সামলান।’ উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানসহ পাকিস্তান প্রত্যাগত প্রায় সকল সেনা কর্মকর্তা ঘাতক চক্রের প্রতি সমর্থন, আর সিজিএস খালেদ মোশাররফসহ আরও অনেকের ‘যা হবার হয়ে গেছে’ এই মনোভাব- সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পদে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রীরাই শপথ নেয়ায় জনগণ যেমন বিভ্রান্ত হয়, তেমনি খুনি চক্রও সময় পেয়ে যায়।
যে কারণে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি তা হচ্ছে: ১. বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে হত্যা করা হয়েছে- এ কথা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি; ২. আবার হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতায় বড় বড় নেতাসহ কেউ কেউ হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন; ৩. হত্যাকাণ্ডের পর পর বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরাই খুনি সরকারের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়। তাছাড়া সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীপ্রধান, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, পুলিশ বাহিনীসহ সকল প্রধানদের খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য ও সমর্থনের ঘোষণা বেতার-টিভিতে প্রচারিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্ক মোতায়েন, কারফিউ জারি ও সঙ্গীন উঁচিয়ে সেনা টহলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেসব নেতারা খুনিদের সমর্থন করেননি তাদেরকে গৃহবন্দি করা হয়। এসব কারণেই খুনিচক্র তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি।
মোশতাক-ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্র বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতিও তারা অবমাননা করেছে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ১৫ আগস্ট সারা দিন, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত শেষে ১৬ আগস্ট বিকেলে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। আর্মির যে কজন বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যায় তারা দাফন-কাফন অর্থাৎ ইসলামি নিয়ম-কানুন পালন না করেই লাশ কবরস্থ করতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু স্থানীয় মৌলবির চাপের মুখে কফিন খুলে বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখানো হয় এবং খুব দ্রুত ১০/১৫ জনের উপস্থিতিতে জানাজা দিয়ে লাশ দাফন করা হয়। আর্মির উদ্যত আচরণের কারণে স্থানীয় লোকজন বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখাতো দূরের কথা- তারা আশেপাশের গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্যদের লাশ বনানী গোরস্তানে ১৫ আগস্ট দিবাগত শেষ রাতে জানাজা-গোসল ছাড়াই কবরস্থ করা হয়।
আরেকটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো বঙ্গবন্ধুর আর্মি, পুলিশ, বিডিআর, প্রায় তিনশ’ জন সংসদ সদস্য, সহকর্মী যারা সেদিন রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী হলেন- তাদের অন্তত একজনও শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখার সাহস করেননি। অথচ এই বঙ্গবন্ধুর কারণেই বাংলাদেশ হলো- ক্যাপ্টেনরা জেনারেল হলো- অনেক অখ্যাত লোক খ্যাত হলো, মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হলো।
হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িত জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, তাহের, মঞ্জুরসহ আরও অনেকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। মাহবুব আলম চাষী- দেশের বাইরে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। প্রায় দুই যুগ চোরের মতো গৃহবন্দি এবং দুর্নীতির দায়ে কয়েক বছর জেল খেটে ১৯৯৬-এর মার্চে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মৃত্যু হয়েছে। ৩৫ বছর পরে হলেও ২০১০-এর ২৮ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুর ৫ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
এতসব কিছুর পরেও যতদিন মানুষের হৃদয়ে স্পন্দন থাকবে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ও বাঙালি থাকবে- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ততদিন শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে।