চলতি ইরি-বোরো মওসুমে বগুড়ার আদমদীঘিতে বোরো মওসুমে ধানের ফড়িয়া, আড়ৎদার ও মহাজনরা সের ও কেজির মারপ্যাঁচে ধান ভেজা ও কাঁচা অজুহাতে ‘ফাউ’ নিয়ে এবং ওজনে কারচুপি করে এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে শত শত মণ ধান আত্মসাৎ করছে।
এলাকার ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ীরা এক বস্তা ধান যে দামে কিনে সেই দামে আড়ৎদার ও মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করলেও তাদের লাভ থাকে। এর নাম হলো সের কেজির মারপ্যাঁচ। দেশের শহরাঞ্চলে সব পরিমাপ কেজি ওজনে হলেও উত্তরাঞ্চল জুড়ে ধান চালের বাজারে এখনো চলে সের মণের ওজন। সের মণের ওজনে ধান কেনা বেচা না হলেও মেপে নেয়া হয় কেজির বাটখারায়। আর এখানেই হিসাবের মারপ্যাঁচে কৃষককে ঠকানো হয়। স্থানীয় প্রশাসন যেমন উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ হাট-বাজার ইজারা দিলেও হাটবাজারের এই অনৈতিক বিষয়গুলো দেখভাল করেন না।
মেট্রিক পদ্ধতির ওজন ব্যবহার না করলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল জরিমানার বিধান থাকলেও নিয়মিত এসব মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় না। এ এলাকার কৃষকেরা ধান ব্যবসায়ীদের এসব কারচুপি থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন স্থানে মৌখিক অভিযোগ করেও কোনো ফল পায়নি। মহাজন ও ব্যবসায়ীদের এসব কারচুপি থেকে বাঁচার জন্য এবং ‘ফাউ’ নেয়া বন্ধের জন্য প্রশাসনের সহায়তা কামনা করেছেন ভুক্তভোগী কৃষকসমাজ।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বিজরুলের প্রয়াত চারণ কবি মোসলেম উদ্দিন ছন্দ ছড়ায় লিখে গেছেন, ‘ধান ফলায় চাষি আর লাভ খায় মাসী’। এই ‘মাসী’ হলো আড়তদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ও বড় ভূস্বামী। কবি মোসলেম উদ্দিন আরো বলতেন ‘কৃষক ফলায় ধান, ব্যবসায়ী পায় মান’। কৃষক কষ্ট করে ফসল ফলালেও তার সঠিক দাম ও সম্মান পায় না। অপর দিকে ব্যবসায়ীরা লাভ পায় ও সম্মানিত হয়।
জানা যায়, উপজেলার প্রায় ১০ থেকে ১২টি হাট-বাজার সহ বিভিন্ন পয়েন্টে এবং পাকা সড়কের ধারে ধান কেনা-বেচার হাট বসে। এসব বিক্রয় কেন্দ্র ও হাটবাজার স্থানীয় প্রশাসন প্রতি বাংলা বছরে ইজারাও দিয়ে থাকে। এসব হাট থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও হাট ইজারাদাররা টোল পায়। এ থেকে সরকারের লাখ লাখ টাকা আয় হয়। এসব হাট-বাজার ও বিক্রয় কেন্দ্রে ওজনের চেয়ে বেশি নেয়া, অতিরিক্ত টোল আদায় এসব বিষয় দেখা হয় না। এ অঞ্চলে দু’চারটি হাটবাজার ছাড়া প্রত্যেক হাট বাজার ও আড়তে কেজির বাটখারায় সেরের ওজন পরিমাপ করা হয়। কেজি থেকে সেরে পরিবর্তন সহজে সাধারণ মানুষ বুঝে ওঠে না। আড়ৎদার মহাজন ধান ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামত ধান মেপে নেয়। এতে সাধারণ কৃষকদের বলার কিছু থাকে না। অনেক কৃষক বাধা প্রদান করলে তাদের ধান আর নেয় না। তখন বিপাকে পড়তে হয় কৃষকদের।
এ অঞ্চলে দুই মণে এক বস্তা হিসেবে ধান বিক্রি হয়ে থাকে ওজন দেয়ার সুবিধার্থে। ৭৫ কেজিতে দুই মণ ধরে এক বস্তা হিসাব করলে কৃষকদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ীরা আড়ৎদার মহাজন ও ধান ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার সময় প্রতি মণে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই কেজি ফাউ নিয়ে থাকে। এ ধানের দাম আড়ৎদার মহাজনরা তাদের দেয় না। বরং নানা কায়দায় ওজনের মারপ্যাঁচে ফেলে তারা সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে বছরে শত শত কেজি ধান আত্মসাৎ করে থাকে।
এভাবে ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ীরা মিল মালিকরা প্রতি মওসুমে একই ভাবে কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল আত্মসাৎ করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ বুনে গেছে। অপর দিকে প্রান্তিক চাষিরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ অঞ্চলে কৃষকদের কোনো সংগঠন নেই। আর কৃষকদের সংগঠন নেই বলে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এসব ওজনের মারপ্যাঁচ ও কৃষক ঠকানো দেখেও দেখে না।
এলাকার ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ীরা জানায়, মিল মালিকরা আমাদের নিকট থেকে এভাবেই ধান কিনে থাকেন। তাদের ৩৯.২৫ কেজির স্থলে সাড়ে ৩৭ কেজি দিলে এক কেজির দাম কম দিয়ে থাকেন। ফলে এলাকার কৃষকদের নিকট থেকে আমরা বাধ্য হয়ে সাড়ে ৩৭ কেজির জায়গায় ৩৯.২৫ কেজি হিসাবে ক্রয় করতে হয়। উপজেলার সদরর ইউনিয়নের জিনইর গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন, কেশরতা গ্রামের কৃষক চঞ্চল হোসেন, চড়কতলা গ্রামের কৃষক শিশির সরকার, তালসন গ্রামের কৃষক হাবুল উদ্দীন অভিযোগ করে বলেন, ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল ওয়েট মেশিনে ওজন দিয়ে সাড়ে ৩৭ কেজির জায়গায় ৩৯.২৫ কেজিতে মণ হিসেবে ধান ক্রয় করে থাকে। অর্থাৎ দুই মণের বস্তায় গড়ে ২ থেকে আড়াই কেজি ধান ওজনে বেশি নিয়ে আমাদের ঠকানো হচ্ছে।
অভিযুক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, বড় বড় মিলারদের কাছে তাদের সাড়ে ৩৭ কেজির জায়গায় ৩৯ কেজিতেই তাদের বিক্রি করতে হয় বলে ক্রেতাদের কাছ থেকে তারা এভাবে ধান কিনে থাকেন। আদমদীঘির কুসুম্বী বাজার, কুন্দগ্রাম বাজার, চাঁপাপুর বাজার ও নশরতপুর বাজার সহ বিভিন্ন বাজারে এসব কারচুপি ও ‘ফাউ’ নেয়ার সংস্কৃতি চালু আছে।
এবিষয়ে উপজেলা কেন্দ্রীয় কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বাবুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ফড়িয়া ধান ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ দিন ধরে এলাকায় কৃষকদের ঠকিয়ে ধান ক্রয় করে আসছে। কোন ভাবেই এদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।