বাংলাদেশ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র,
চীন এবং রাশিয়া যেসব তৎপরতা এবং বক্তব্য দিয়েছে তাতে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আসন্ন সাধারন নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের
উপর যুক্তরাষ্ট্রর চাপ দৃশ্যমান হলেও চীন এবং রাশিয়ার অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের বিরোধ এখন দৃশ্যমান। এর প্রভাব বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পড়ছে বলে
মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে বাংলাদেশ
বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে কী না তা নিয়ে নানা মত আছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ
মনে করেন- বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং বঙ্গোপসাগরের প্রতি
বৈশ্বিক আগ্রহ - এসব কারণে রাজনৈতিক মেরুকরণের নতুন ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে
দ্বিমতও আছে। বিশ্লেষকদের আরেকটি অংশ মনে করছেন, বাংলাদেশ নিয়ে শক্তিধর দেশগুলোর আগ্রহ
থাকলেও সেটা খুব বেশি নয়।
আমেরিকা কী চায়?
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, বাংলাদেশ আসলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার নতুন
‘মেরুকরণের ক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছে।
তার বিশ্লেষণ হচ্ছে , বাইডেন প্রশাসনের
পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার
প্রতিষ্ঠার’ পক্ষে কাজ করা।
এরই অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশের বিষয়ে আগ্রহী হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আমেরিকার একটা ইন্দো-প্যাসিফিক
কৌশল আছে যেটি সক্রিয়ভাবে কার্যকর করতে তারা মনোনিবেশ করেছে। এ কারণেই এশিয়া অঞ্চলে
বন্ধু সংগ্রহে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, আমেরিকার লক্ষ্য চীন-রাশিয়া
বলয় থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের বলয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা বা সংযুক্তিকে আরো
শক্তিশালী করা।
কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ইউরোপীয়
ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোও চায় বাংলাদেশে যাতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। একই সাথে এসব দেশে
বাংলাদেশকে যেসব সুবিধা, বিশেষ করে বাণিজ্য সুবিধা দেয়া হয়, তার পেছনে মূল উদ্দেশ্য
হচ্ছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী রাখা।
কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর যেহেতু এই অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতা বাড়ছে, তাই এই দেশগুলো বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে আদর্শগত মিল বাড়ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের সাথে যেহেতু তাদের আদর্শগত মিল নেই তাই তারাও এই অঞ্চলে বন্ধু সংগ্রহে আগ্রহী।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এখানে মূল
বিষয় হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন তিনি।
হুমায়ুন কবীর বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ
বিষয়গুলোকে আমরা খুব সংগঠিতভাবে ব্যবস্থা না করার সুযোগটা রাশিয়া-চীন নেয়ার চেষ্টা
করছে এবং এ কারণেই আমরা বাংলাদেশকে ঘিরে এই তিন-চার কেন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা বেশি
দেখতে পাচ্ছি।
এদিকে চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের
অবকাঠামো নির্মাণে চীন ব্যাপকভাবে কাজ করছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক।
রাশিয়ার সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটা
একই রকম। বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎখাতে রাশিয়ার বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার
সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কও রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া বাংলাদেশের
পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এছাড়া এই দেশটি থেকে বাংলাদেশ খাদ্য শস্যও আমদানি করে থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান মনে করেন, বাংলাদেশ না চাইলেও ভূ-কৌশলগত
অবস্থানের কারণে স্বাভাবিকভাবেই সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তিনি মনে করেন, গত বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের
অর্থনৈতিক উন্নয়ন এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ অগ্রগামী ছিল। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি
কোভিড পরবর্তী সময়েও বেশ স্থিতিশীল ছিল যা একে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত
করেছে।
ড. সাহাব এনাম খান বলেন, বাংলাদেশ একদিকে
চীন থেকে ব্যাপক আমদানি করে এবং অন্যদিকে আবার পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানিও করে। ফলে
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বার্থের একটা ভারসাম্য বাংলাদেশ রক্ষা করে আসছে।
কানাডাভিত্তিক অনলাইন প্রকাশনা ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’ অনুসারে, বাংলাদেশ
বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের
অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি ধরে রাখা যায় তাহলে মধ্যম শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে
বলে মনে করেন তিনি। একই সাথে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় বাজারও। যার কারণে এর
প্রতি সুপার পাওয়ার দেশগুলো বিনিয়োগের আগ্রহ বেড়েছে।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের অংশ
যা ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। ফলে এটি অনেকটা ‘স্ট্রাটেজিক লাইন
অব কমিউনিকেশন’ বা ‘সাপ্লাই লাইন
অব কমিউনিকেশন’ হয়ে উঠেছে বলে
মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক। এ কারণে বঙ্গোপসাগেরের গুরুত্ব অনেক।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক এবং সমর বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, চীন-রাশিয়া-আমেরিকার দ্বন্দ্বে
বাংলাদেশ আসলে ‘গৌণ বা উপলক্ষ্য’ মাত্র।
তার মতে, বাংলাদেশের মেরুকরণের ক্ষেত্রে
পরিণত হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর ঘনিষ্ঠতর
হওয়া এবং এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আমেরিকার অবস্থান।
মাহমুদ আলী বলেন, স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী
সময়ে ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর সারা বিশ্বে ইউনিফর্ম বা একক পরাশক্তি
হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সেই আধিপত্য পরবর্তী ২৫ বছর পর্যন্ত চলেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের শক্তিশালী দেশ ব্রিটেন,
ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, এরা সবাই তখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রপক্ষের দেশ ছিল। বিপক্ষে
কেউ না থাকার কারণে আমেরিকা প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ছিল।
তার বিশ্লেষণ হচ্ছে, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া
রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত হওয়া এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক শক্তি বাড়ানোর মতো ঘটনার
পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে যে যুক্তরাষ্ট্র আর একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে
পারছে না। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-রাশিয়ার মধ্যে একধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
সামনে আসে।
সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, যেহেতু ক্ষমতার একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে চলছে, তাই বলা যেতে পারে বাংলাদেশ একটি গৌণ বা পরোক্ষভাবে একটি প্রতিদ্বন্দ্বীতার কেন্দ্র বা স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা