আজ ১৫ আগস্ট,
জাতীয় শোক দিবস। ১৫ আগস্ট বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, ঘৃণিত, বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের
একটি দিন। এদিন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে
হত্যা করা হয়।
এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর
নিচ্ছক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল না। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র ও জাতির অগ্রযাত্রাকে
চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
বাংলাদেশের মহান
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তি এবং ঘাতক চক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের এদিনে
সপরিবারে হত্যা করে। এদিনটি বাঙালির জাতির শোকের দিন।
সোমবার (১৫ আগস্ট)
জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতি শোকাতুর হৃদয়ে শ্রদ্ধাভরে তার জনককে স্মরণ করছে। দিবসটি
উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। আওয়ামী
লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন, সরকারি, বেসরকারি
সংস্থা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। শোকাবহ ও গভীর শ্রদ্ধাভরে বাঙালি
জাতি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছে।
ঔপনিবেশিক শাসনসহ
হাজার বছরের নির্যাতিত নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে। পর্বতসম সাহস আর সাগরের মতো হৃদয়ের অধিকারী
শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালিকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-নির্যাতনের শৃঙ্খল
থেকে মুক্ত করেছিলেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে বাঙালির অধিকার আদায়ের
আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেসঙ্গে তিনি বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের
মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা
করলেও জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবেই আজ বঙ্গবন্ধু তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের
অবসান হলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালি জাতি। হাজার
মাইল ব্যবধান ও ভাষা, সংস্কৃতির পার্থক্য সত্ত্বেও বাঙালি জাতি ও তাদের ভূখণ্ডকে করা
হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনস্থ অংশ। বাঙালির ওপর চেপে বসে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের
শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন। সেই নির্যাতিত বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা
সংগ্রামের পথে ধাবিত করেন শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ
মুজিব হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। এ আন্দোলন-সংগ্রামের
নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে
সারা দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে
পড়ে। এদিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর
বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
বাঙালি অধিষ্ঠিত করে তাদের জাতির পিতার আসনে।
ভাষা আন্দোলন
থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী
দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তার অতুলনীয় গণমুখী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯ এর চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ৭০- এর নির্বাচনে বিপুল
বিজয়, এর পর ১৯৭১- এ এসে উপনীত হয়। ৭১-এর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে ঘরে ঘরে
দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’ বঙ্গবন্ধুর এই ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত
হয় বাঙালি। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
স্বাধীনতার পর
দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে
যেতে থাকে। দীর্ঘ দিনের শোষিত-বঞ্চিত এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি
দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময়ও তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি
হন। সব ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা
ও দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা
তাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র
বাস্তবায়নে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর
বিপথগামী একটি দল আক্রমণ করে। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সবাইকে একে একে
হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পাননি। বঙ্গবন্ধুর
দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তারা প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার
পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র
ভুলুণ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে পদদলিত করে
উল্টো পথে সেই পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। আবারও বাঙালির ঘাড়ে
জেঁকে বসে সামরিক স্বৈরশাসন। জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপগুলো
নিয়েছিলেন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যা,
ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালা বদল হতে থাকে।
সেই সঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র
সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় চিহ্নিত
স্বাধীনতাবিরোধীরা।
স্বাধীনতার মাত্র
সাড়ে চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এ হত্যাকাণ্ডের
আরও শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র
ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ
রাসেল, পুত্রবধূ দেশবরেণ্য সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি,
বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত,
তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ
বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায়
এগিয়ে আসা বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।