আগামী ৯ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। এটা স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি হবে চতুর্থ বাজেট। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৭৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বেশি। নতুন এই বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি ধরা হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। করোনাভাইরাস সঙ্কট পরবর্তী অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রধান্য দিয়ে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা করা হচ্ছে।
আগামী বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগামী অর্থবছরে ঘাটতি বাড়তে পারে ২৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে আগামী বাজেটে মোট আয় বাড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি জিডিপির প্রায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হবে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। এছাড়া আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর বহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ১৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বাজেটের মোট আকার শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে-কমতে পারে। এ ছাড়া আসন্ন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে যা ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে যেসব খাতে বেশি করে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া হতে পারে, সেগুলো হচ্ছে বিদ্যুত খাত ১৮ হাজার কোটি টাকা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্য পরিশোধ ও প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ভর্তুকি ১৭ হাজার ৩০০ কোটি, খাদ্য ভর্তুকি ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি এবং কৃষি প্রণোদনা বাবদ ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুত, সার ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা না হলেই অবশ্য এমনটা হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা এবং দেশের প্রধান রফতানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে মন্দার পূর্বাভাস সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখনকার তুলনায় নতুন অর্থবছর বেশ কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ হলে এবং নতুন করে দেশে কোভিড পরিস্থিতির অবনতি না হলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি অনুসরণ করার পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বাড়তি ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যা সংশোধিত বাজেটেও অপরিবর্তিত থাকছে। মূলত, আমদানি-রফতানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবাখাতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসা, কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পাশাপাশি বাড়তি রাজস্ব আয়ের কারণে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া, নতুন অর্থবছরে রফতানির প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি দেশের শিল্প ও কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। চলতি অর্থবছর জনশক্তি রফতানিতে ৩৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় খুব শীঘ্রই রেমিটেন্স প্রবাহেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ দশমিক ৮৬ শতাংশের বেশি, এই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪৬ দশমিক ২১ শতাংশ। তবে আমদানি ব্যয়ের মধ্যে পেট্রোলিয়াম ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীতে বাড়তি প্রবৃদ্ধির। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ ও জুলাই-জানুয়ারি সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ৫১ শতাংশেরও বেশি।
গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪৮ শতাংশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ২৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাকি সময়েও প্রধান দুই বাজারে রফতানি প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকবে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের কিছুটা ডিপ্রেসিয়েশন হয়েছে। গত মার্চ শেষে এই হার ছিল ডলার প্রতি ৮৬ দশমিক ২০ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৪.৮০ টাকা; তবে এটি উদ্বেগজনক নয়। বর্তমান অর্থবছরে ইউরোর বিপরীতে টাকা কিছুটা শক্তিশালী হচ্ছে। চলতি মার্চ শেষে ইউরোর বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৯৪ দশমিক ৬৫ টাকা, গতবছর একই সময়ে এটি ছিল ১০১ দশমিক ০৬ টাকা।
তবে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হওয়ার আশঙ্কার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যপণ্যসহ পণ্যবাজার সার্বিকভাবে উর্ধমুখী থাকায় সামনের দিনগুলোতে উন্নয়ন ব্যয়সহ সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক মূল্য পরিস্থিতিতে জ্বালানি, বিদ্যুত, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি, কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্যের দাম সহসাই কমবে- এমন ধারণা করার ভিত্তি নেই। পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট, গ্যাস, বিদ্যুতসহ বাংলাদেশে কিছু গৃহস্থালি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। আবার ফেব্রুয়ারিতে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আগামী বছর বিনিয়োগ থেকে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি আসবে বলে মনে হয় না। ভোক্তা ব্যয় বাড়ছে মূলত মূল্যস্ফীতির কারণে। তাই ভোক্তার প্রকৃত ব্যয় বাড়েনি। সরকারী ব্যয়ও খুব একটা বাড়েনি।
রেমিটেন্স প্রবাহও আগের অর্থবছরের তুলনায় এবার কমে গেছে, যা ভোক্তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছর ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং কোভিড পরিস্থিতির অবনতি না হলে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হওয়া স্বাভাবিক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হলেও ইউরোপের মন্দার ঝূঁকি রয়েছে, যা আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। এ বছর জনশক্তি রফতানি অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন বছর রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। সার্বিক পরিস্থিতিতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আগামীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন প্রয়োজন হতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি উস্কে দেবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে জ্বালানি তেলের দাম কমবে। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে গেলেও সরকার দেশে দাম সমন্বয় করেনি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমবে, তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে। এখনও অনেক সময় আছে। সামনে কি হয়, তা তো বুঝা যায় না। পরিস্থিতি যদি এরকম থাকে, তাহলে এসব লক্ষ্যমাত্রা কোনমতেই অর্জন করা সম্ভব হবে না। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা মোটেও অসম্ভব হবে না।
চলমান যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির আশঙ্কা ছাড়া অর্থনীতির বাকি সব সূচকই ইতিবাচক। দেশে কোভিড সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের (এপ্রিল-মে ২০২০) সময়ে শিল্প উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু ওই বছরের জুলাই থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। ২০২১ এর মে-জুলাই সময়ে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় শিল্প উৎপাদন কিছুটা স্তিমিত হলেও মহামারী পূর্ব সময়ের অবস্থার উপরে ছিল। এখন ম্যানুফ্যাকচারিংখাত কোভিডের ক্ষতি সামলে নিয়ে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পের উৎপাদন সূচকে উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন ঘটেছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় বর্তমান অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি উর্ধমুখী রয়েছে এবং আগামীতেও এভাবে থাকবে বলে আশা করা যায়।