শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে অকল্পনীয় সব প্রতিশ্রুতি দেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। ভোটার টানতে বড় আকারে ট্যাক্স মওকুফের ঘোষণা দেন। মূল্য সংযোজন কর ১৫ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনাসহ অন্যান্য করে বড় ছাড় দেয়ার কথা জানান। প্রচারাভিযানে দেয়া তার এসব প্রতিশ্রুতিকে স্টান্টবাজি হিসেবে অ্যাখা দিয়েছিলেন অনেকে। তত্কালীন অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাবিরা গোতাবায়ার এমন ঘোষণাকে বিপজ্জনক হিসেবে মন্তব্য করেন। সতর্ক করে বলেন, এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত শ্রীলংকাকে কেবল দেউলিয়াই করবে না, ভেনিজুয়েলা ও গ্রিসের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তার ওই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপ নিতে সময় লেগেছে মাত্র আড়াই বছর। রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতার মসনদে ভাঙন ধরেছে। ধারাবাহিক বিক্ষোভে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। টালমাটাল রাজাপাকসে পরিবারের শাসন।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য রাজাপাকসে পরিবার জনগণের ওপর করের চাপ কমানোর যে প্রলোভন দেখিয়েছে, সেটি আজ দেশের জন্যই হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিয়েছে। ঋণে জর্জরিত দেশটির রাজস্ব কমে যাওয়ার অর্থ ছিল তাদের নগদ অর্থের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ধরনা দেয়ার পথ তৈরি হওয়া। এমন ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সে সময়কার নীতিনির্ধারকরা বুঝলেও রাজাপাকসে পরিবারের কাছে ক্ষমতায় আসাটাই ছিল মুখ্য।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনৈতিক ক্ষমতার অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে রাজাপাকসে পরিবার। পরের বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অধীনে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি। ২০২১ সালে তাদের আরেক ভাই বাসিল রাজাপাকসেকেও সরকারে আনা হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় অর্থমন্ত্রীর। সরকারে আনা হয় পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। এভাবে শ্রীলংকার রাজনীতি, সরকার ও ক্ষমতার মসনদে রাজাপাকসে পরিবারের অবস্থান শক্ত হয়ে ওঠে। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার হয়ে ওঠে তারা। তবে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠার সেই দৌড় থমকে যায়। যার শুরুটাও রাজাপাকসে পরিবারের হাত ধরেই।
প্রতিশ্রুতি মতো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই ট্যাক্স কমিয়ে দেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। ফিরিয়ে আনেন প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা। কর্তৃত্ববাদী শাসনক্ষমতায় পাকাপোক্ত হওয়ার বাসনা আরো জেঁকে বসে রাজাপাকসে ভাইদের মাঝে। ঋণ নিয়ে আগ্রাসীভাবে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেন তারা। তবে অব্যবস্থাপনা আর অবাধ দুর্নীতি দেশটিকে খাদের কিনারে টেনে আনে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে মুদ্রাস্ফীতি। প্রকট হতে থাকে জ্বালানির সংকট। বিদ্যুৎ ছাড়াই থাকতে হয় নাগরিকদের বেশির ভাগ সময়। অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে খাদ্যনিরাপত্তা। ফুরিয়ে আসে আমদানি সক্ষমতাও। বিপরীতে ঋণে জর্জরিত দেশ। নাগরিকদের খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে অনুদানের জন্য দাতা সংস্থা ও অন্য দেশের কাছে হাত পাততে হয় তাদের। মুদ্রাবাজার থেকে উচ্চসুদে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয় শ্রীলংকা। এ ঋণ ও তার সুদ পরিশোধ করতে না পেরে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে সরকার।
শুধু এবারের নির্বাচনই নয়, শ্রীলংকার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই রাজাপাকসে ভাইদের মধ্যেই ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। সেই অর্থে অর্থনৈতিক দুর্বলতার মধ্যেই ক্ষমতায় আসে রাজাপাকসে পরিবার। ক্ষমতায় আসার পর চীন থেকে বড় আকারে ঋণ নেয় সরকার। গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এশিয়ার মধ্যে নিজেদের আরেক সিঙ্গাপুর বানানোর উচ্চাভিলাষ জেগে বসে রাজাপাকসে ভাইদের মাঝে। যদিও বেশির ভাগ প্রকল্পই শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয় ঋণের পরিমাণ। ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে সন্ত্রাসী হামলা অর্থনীতির ওপর আরো চাপ তৈরি করে। পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় করোনা অতিমারী।
গত এপ্রিলে সরকারের অদূরদর্শী আরেক সিদ্ধান্ত শ্রীলংকার আর্থিক বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করে। সরকার হঠাৎ করে এ সময়ে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। মূলত ডলার সাশ্রয় করার জন্যই ওই উদ্যোগ নেয়। উদেশ্য ছিল সার আমদানি বন্ধ করে অর্গানিক কৃষিতে ঝোঁকা। তবে সেটি বুমেরাং হয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ধস নামে। রফতানি আয়ের অন্যতম উৎস চায়ের উৎপাদনেও ধস দেখা দেয়। এ খাত থেকে রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসে। বিপরীতে খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ধস দেখা দেয়ায় বাধ্য হয়ে চালসহ খাদ্য আমদানি করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যপণ্যের ব্যয় বাড়তে থাকে। নিত্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে নাগরিকরা। সবকিছু মিলিয়ে নাগরিকদের মাঝে ক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় নাগরিকরা ফুঁসে ওঠে। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। পদে টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করেও পারলেন না মাহিন্দা রাজাপাকসে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের মধ্যেই সহিংসতায় এক এমপিসহ অন্তত সাত শ্রীলংকান নিহত হয়েছে। এ অবস্থায় সহিংস এ উসকানির জন্য মাহিন্দা রাজাপাকসেকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন দেশটির আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, তারকা ক্রিকেটারসহ বিভিন্ন স্তরের নাগরিক। পাশাপাশি গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিও জোরালো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজাপাকসে পরিবারের দীর্ঘদিনের ক্ষমতা এবার খর্ব হতে চলেছে। গত দুই দশকের মধ্যে ১২ বছরই দ্বীপরাষ্ট্রটির শাসন করতে থাকা পরিবারের ডিক্টেটরশিপ এখন ধ্বংসের মুখে। যেকোনো সময় গোতাবায়াকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হতে পারে। আর সেটি হলো দেশ ও দেশের বাইরে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তাদের। মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ ও দুর্নীতির দায়ে বিচারের আওতায় আসতে হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করে যাবেন গোতাবায়া। যে কারণে অনেকটা কৌশলেই ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে অনুরোধ করেন তিনি। উদ্দেশ্য চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।
সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী অসীম ক্ষমতা উপভোগ করছেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট। মন্ত্রিপরিষদ নিয়োগ থেকে শুরু করে তাদের বহিষ্কার ও অপসারণের ক্ষমতা রাখেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকেন এবং নিজে যেকোনো জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে পারেন। নির্বাহী প্রেসিডেন্টের এমন অসীম ক্ষমতার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিরোধী দলগুলো। তারাও গোতাবায়ার পদত্যাগ দাবি করছে। চলতি সপ্তাহে গোতাবায়ার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন ইস্যুতে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকও ডেকেছেন সংসদের স্পিকার। ফলে শেষ পর্যন্ত রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতায় টিকে থাকা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।