বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ এমভি অউসু মারো ভেড়ানোর মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দরের স্বীকৃতি পেল মহেশখালীর মাতারবাড়ি। আর দুদিনের মাথায় আন্তর্জাতিক নোটিশও জারি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
আশি হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে আসা ২৩০ মিটার দীর্ঘ এবং সাড়ে ১৪ মিটার গভীরতার পানামার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি অউসু মারো ২৫ এপ্রিল মাতারবাড়ি ভিড়ে। এখন থেকে ওই বন্দরের কয়লার জেটিতে ২৩০ মিটার দীর্ঘ এবং সাড়ে ১২ মিটার গভীর, দেড়শ’ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ অয়েল টার্মিনালে এবং দেড়শ’ মিটার দীর্ঘ ও ছয় মিটার গভীরতার জাহাজ প্রবেশ করবে অস্থায়ী এক নম্বর জেটিতে।
জানা গেছে, ২২৯ মিটার দীর্ঘ ও ১২ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের কোনো জাহাজ এর আগে দেশে ভিড়েনি। সমুদ্র থেকে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৫০ মিটার চওড়া কৃত্রিম চ্যানেলের মধ্য দিয়ে জাহাজটি জেটিতে আনা হয়। ইতোমধ্যে এ জেটিতে ১১২টি জাহাজ জেটিতে ভিড়লেও সেগুলোতে ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উপকরণ। মাতারবাড়ীতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ ভিড়েছে জানিয়ে ওইদিন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ২২৯ মিটার দীর্ঘ ও ১২ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট’র (জাহাজের পানির নিচের গভীরতা) পানামার পতাকাবাহী এমভি ‘অউসো মারো’ মাতারবাড়ীতে ভিড়েছে। এটি বন্দরের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর আগে দেশে এত বড় ও গভীরতার জাহাজ ভিড়েনি। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে এখন সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ আনার সুযোগ আছে। পায়রাবন্দরেও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভিড়েছে ১০ দশমিক ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ।
এদিকে একেবারেই অনিশ্চয়তা থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের। এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক বিরোধের প্রভাব পড়েছিল এই মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের কাজেও। বিশেষ করে প্রথম পর্যায়ে সোনাদিয়া এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সরকারের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে চীন। কিন্তু সমীক্ষা রিপোর্টে সোনাদিয়ায় বন্দর নির্মাণ নেতিবাচক হওয়ায় মাতারবাড়ি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। আর তাতে চীনের পাশাপাশি আগ্রহী হয়ে ওঠে প্রতিবেশী দেশ ভারতও। কিন্তু শক্তিধর দুই রাষ্ট্রের চাপের মুখে বাংলাদেশ অনেকটা নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত বন্দর নির্মাণে কাজে আসে জাপানি কৌশল।
জানা যায়, শুরুতে সিদ্ধান্ত হয় চীন এ বন্দর নির্মাণ কাজ করবে। কিন্তু এরপর সরকার পরিবর্তন হলে সেখানে পিছিয়ে পড়ে চীন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করলে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ‘বিগ বি’ ধারণাটি দিলে শেখ হাসিনা সেটি গ্রহণ করেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয় মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণসামগ্রীর পাশাপাশি কয়লা খালাসের জন্য দুটি জেটি তৈরি করে জাপানি কর্তৃপক্ষ। এমনকি খনন করা হয় সাড়ে ১৬ মিটার গভীর, দেড় কিলোমিটার প্রস্থ এবং প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন চ্যানেল। আর এই অবকাঠামোকেই সামনে রেখে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তাতে প্রস্তাবনার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। চীন ও ভারতের জটিলতা এড়িয়ে জাপানের প্রস্তাব বাংলাদেশ লুফে নেয়। এখানে সবকিছু হয়েছে জাপান সরকার এবং জাইকার অর্থায়নে। ফলে চ্যানেলটি কাজে লাগাতে জাপানই বাণিজ্যিক বন্দর করার প্রস্তাব দেয়। যেটি লুফে নেয় বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত কিংবা চীন এই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের দায়িত্ব পেলে সৃষ্টি হতো নানা জটিলতা। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ত সমুদ্র-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশগুলো। ফলে বড় ধরনের সংকেটর মুখে পড়ত বাংলাদেশের বিশাল বিনিয়োগ। কিন্তু বিশ্বজুড়ে নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে জাপানের সুনাম রয়েছে। আর তাতেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে পুরোদমে অপারেশনে যাওয়ার কথা রয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার এই গভীর সমুদ্রবন্দরের। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে এরই মধ্যে ১১৩টি জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে।