সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার চট্টগ্রামের আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু খুনের মাস্টারমাইন্ড- এ তথ্য স্বীকার করে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়েছিলেন কারাবন্দি আসামি মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম। তাকে রাজসাক্ষী করতে সব প্রস্তুতি শেষও হয়েছিল। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমার বদলিতেই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। ওয়াসিমকে রাজসাক্ষী করার সেই চেষ্টা এখন আর নেই। স্ত্রী খুনে বাবুলের বিরুদ্ধে দালিলিক ও প্রযুক্তিগত প্রমাণ সংগ্রহ করে মামলার তদন্ত গুছিয়ে এনে সমাপ্তির পথেও হাঁটছিলেন সন্তোষ কুমার। কিন্তু পিবিআই থেকে সিএমপিতে তার বদলির সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শকাতর এই মামলার তদন্তের গতিপথ চোরাবালিতে হাবুডুবু খেতে শুরু করে। উল্টো খুনের দায় থেকে বাবুল আক্তারকে বাঁচাতে মামলার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালতে শুরু করে বৃহৎ এক শিল্প গ্রুপ। তাকে জামিন করাতেও গ্রুপটি মরিয়া হয়ে উঠেছে। তদন্তের ফাঁকফোকর খুঁজে তা আদালতে উপস্থাপন করে নতুন নতুন জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। কারাগারে নতুন স্ত্রী ইসমত জাহান মুক্তার প্রশংসায় বাবুল সবসময় পঞ্চমুখ থাকলেও মিতুর বিষয়ে থাকেন নিশ্চুপ। কারাগারেও দুই হাতে খরচ করছেন তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে (পিসিতে) জমা করা হাজার হাজার টাকা।
মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, মিতুর মামলায় বাবুলের হাতের লেখা পরীক্ষা করা হচ্ছে। আদালতের আদেশ নিয়ে মিতুর সন্তানদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখনও ছোট ছোট বহু তদন্তকাজ বাকি রয়েছে। নিখুঁতভাবে তদন্ত করায় কখন শেষ করা যাবে, তা বলা সম্ভব হচ্ছে না।
আগের তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমানে সিএমপির খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, বাবুল আক্তার স্ত্রী খুনে মুছাকে যে অর্থ দিয়েছিলেন, তার প্রযুক্তিগত ও সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি সংগ্রহ করে দিয়ে এসেছি। বাবুলের বিরুদ্ধে খুনের সব রকম তথ্য-প্রমাণ মামলার নথিতে রাখা হয়েছে। আমি ৮০-৯০ ভাগ তদন্ত শেষ করেছিলাম। বদলি হওয়ায় বাকি কাজ শেষ করতে পারিনি। এখন নতুন তদন্ত কর্মকর্তা একটি তথ্যের সঙ্গে আরেকটি তথ্যে জোড়া লাগাচ্ছেন। তিনি জানান, বাবুলের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়েছিলেন আসামি ওয়াসিম। সব প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। এখন মনে হয় সেই প্রক্রিয়া আর এগোয়নি।
ওয়াসিমের চোখে খুনের মাস্টারমাইন্ড বাবুল :মিতু খুনে মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম সরাসরি সম্পৃক্ত ও মামলার অন্যতম আসামি। এখন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সেলে রয়েছেন। মিতু মামলার শুনানিতে কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসেন তিনি। সম্প্রতি আদালতে একান্তে ওয়াসিমের সঙ্গে কথা বলে সমকাল। ওয়াসিম বলেন, বাবুল আক্তার গভীর রাতে মুছার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতেন, যাতে বাবুল আক্তারের কথা রেকর্ড না হয়। কিন্তু মুছা দুষ্ট হওয়ায় তা লাউডস্পিকারে দিয়ে আমাদের শোনাতেন। শুধু বাবুলের সঙ্গে কথা বলার জন্য মুছাকে একটি সিমও দিয়েছিলেন বাবুল। ওই সিম দিয়ে বাবুল আক্তার ছাড়া আর কারও সঙ্গেই কথা বলতে পারতেন না মুছা। একদিন কথা বলার সময় ফোন কল লাউডস্পিকারে থাকায় মিতুকে খুন করার কাজ কতদূর এগিয়েছে তা জানতে চান। মুছা করে দেব বলে জানায়। তারপর বাবুলের পরিকল্পনায়ই মিতুকে খুন করা হয়। মুছা ছিল বাস্তবায়নকারী আর মাস্টারমাইন্ড বাবুল আক্তার। তিনি বলেন, আমি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজসাক্ষী হওয়ার চিন্তাভাবনা করেছিলাম। সন্তোষ স্যার আমাকে রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য রাজি হতে বলেছিলেন। বাবুল আর মুছার কারণে আমরা আজ জেলে বন্দি।
কারাগারে ঢুকেই মুখ বন্ধ রাখার বার্তা পাঠান বাবুল : স্ত্রী খুনের মামলায় আসামি হয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে যাওয়ার পর দিনই কারাবন্দি অন্য আসামিদের বিশেষ বার্তা পাঠান বাবুল। কারাগারে বাবুল যে সেলে বন্দি ছিলেন, তার পাশের সেলেই ছিলেন মামলার অপর আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেন। বাবুল তাদের খোঁজখবর জানার জন্য এক সেবক বন্দিকে দিয়ে বার্তা পাঠান। সঙ্গে ছিল কারা ক্যান্টিন থেকে আনানো চা-বিস্কুটও। বাবুলের বার্তা পাওয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ওয়াসিম ও আনোয়ার। তারা বার্তাবাহককে বলেন, আমরা কারাগারে আসার পর বাবুল একদিনের জন্যও নিজে কিংবা অন্য কারও দিয়ে আমাদের ও পরিবারের কোনো খবর নেননি। তিনি আমাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে বেঁচে যাবেন মনে করেছিলেন। তাই আমাদের খবর নেননি। আজ নিজে আসামি হয়ে আসার পর আমাদের খবর নিচ্ছেন। মুছাকে কথা দিয়েছিলেন কাজটি (মিতুকে হত্যা) করার পর আমাদের সবার দায়িত্ব নেবেন বাবুল। তিনি তার দেওয়া কথা রাখেননি। এ মেসেজ বাবুলের কাছে পৌঁছানোর পর বাবুল তাদের জামিন করানোসহ সবকিছু দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফের মেসেজ পাঠান। সঙ্গে মিতু খুনে বাবুলের সম্পৃক্ততার কথা কোনোভাবেই ১৬৪ কিংবা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলা যাবে না বলে মুখ বন্ধ রাখার বার্তা পাঠান। একইভাবে কারাবন্দি সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু ও শাহজাহান মিয়ার কাছে একই বার্তা পাঠিয়েছিলেন বাবুল। ওয়াসিম ও কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায়।
বাবুলের মামলার সব খরচ দিচ্ছে এক বৃহৎ শিল্প গ্রুপ :বাবুল আক্তারকে বাঁচাতে মামলা পরিচালনার পেছনে যত খরচ হচ্ছে, তার সবটাই মেটাচ্ছে একটি বড় শিল্প গ্রুপ। চট্টগ্রাম আদালতে নতুন নতুন পিটিশন দাখিল করা, শুনানিতে একাধিক সিনিয়র আইনজীবীকে দাঁড় করানো, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন শুনানি, আদেশের নকল কপি সংগ্রহ, মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন শুনানি ও আদেশের নকল কপি সংগ্রহ, হাইকোর্টে জামিন ফাইল করা ও শুনানি- সবই হচ্ছে ওই শিল্প গ্রুপের টাকায়। খোদ এসব তথ্য জানিয়েছেন বাবুল আক্তার নিজেই। এক শীর্ষ কারা কর্মকর্তা জানান, বাবুল আক্তার তাকে বলেছেন, তিনি একটি শিল্প গ্রুপে বড় পদে চাকরি করতেন। পুলিশে চাকরি যাওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করে আসছিলেন। তিনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেই প্রতিষ্ঠানে প্রচুর সিস্টেমলস হতো। বাবুল যোগদানের পর সেই সিস্টেমলস অনেকটাই কমিয়ে আনেন। তাই ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা তাকে খুবই পছন্দ করেন। তাকে বলেছেন, তুমি যখনই ফিরে আসবে তোমার জন্য ওই চেয়ার ফাঁকা থাকবে।