আইস। ইংরেজি শব্দ। অর্থ বরফ। এই আইস দেখতে
বরফের মতো হলেও আসলে বরফ নয়। এটি এখন মাদকের সর্বশেষ সংস্করণ। এক ভয়ংকর মাদকের নাম
‘আইস’। আবার এর পরিচিতি
রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। অভিজাত শ্রেণির কাছে ‘স্কোর’, কেউ বলেন, ‘স্টাফ’। কারও কাছে আবার
সাদা নামে পরিচিত। তবে গোপন যোগাযোগের সময় অনেকেই ডাকেন ‘বরফ’ নামে। স্বাদ,
গন্ধ ও বর্ণহীন বলে বহির্বিশ্বে পরিচিত ‘ক্রিস্টাল মেথ’ হিসাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক হিসাবে আইসের
ভয়াবহতা শিউরে ওঠার মতো। এটি ইয়াবার চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী। আইসের জালে একবার জড়ালে
একমাত্র মৃত্যুই হতে পারে মুক্তির উপায়। কারণ একবার আইসসেবনে অন্তত ৩০টি ইয়াবাসেবনের
চাইতেও বেশি ক্ষতি হয়। এ কারণে আইসে আসক্ত হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ব্যক্তির কেন্দ্রীয়
নার্ভ সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
শতগুণ ভয়ংকর: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা
ও আইসের মূল উপাদান একই। মিথাইল অ্যামফিটামিন বা মেথা অ্যামফিটামিন। বড় আকারের একটি
ইয়াবায় অ্যামফিটামিনের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫ থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু আইসে অ্যামফিটামিন
থাকে ৯৬ শতাংশ বা তারও বেশি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাসায়নিক
পরীক্ষাগারের প্রধান ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, মিথাইল অ্যামফিটামিন একধরনের
স্টিমুলেটিং এজেন্ট। এটি মানবদেহের কেন্দ্রীয় নার্ভ সিস্টেমকে ক্ষণিকের জন্য আন্দোলিত
করে তোলে। ফলে সেবনকারী প্রফুল্লতা অনুভব করেন। চারপাশের সবকিছু তার কাছে রঙিন মনে
হয়। কিন্তু নেশার ঘোর কেটে গেলে শুরু হয় প্রতিক্রিয়া। মাদকাসক্ত ব্যক্তি ক্রমশ বিমর্ষ
হয়ে পড়েন। গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। টানা কয়েক মাস আইসসেবনের
ফলে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ড্যামেজ হয়ে যায়। তখন কেবলই মৃত্যুর হাতছানি।
জেনেশুনে বিষপান: আইস ব্যয়বহুল নেশা।
এক গ্রাম আইসের বাজারমূল্য ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। ফলে স্বাভাবিকভাবে আইসের ব্যবহার
হচ্ছে ধনাঢ্য শ্রেণির মধ্যে। এখন পর্যন্ত আইস-সংশ্লিষ্টতায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে,
তাদের প্রায় সবাই কোটিপতির সন্তান। কেউ কেউ নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাজীবন শেষ
করেও নাম লিখেয়েছেন নেশার জগতে।
সূত্র বলছে, গত বছর ৬ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর
থেকে গ্রেফতার হন আফিফ আফতাব খান সুহৃদ নামের এক ধনাঢ্য যুবক। অভিজানের সময় সৃহৃদ কথা
বলছিলেন ইংরেজিতে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি উচ্চতর ডিগ্রিধারী। স্ত্রীও উচ্চশিক্ষিত
এবং রাজধানীর একটি নামকরা কলেজের অধ্যাপক। বাবা ছিলেন জেলা রেজিস্ট্রার। পরিবারের অন্য
সদস্যদের সবাই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। দুই ভগ্নীপতির একজন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের
সদস্য এবং অপরজন একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। ঢাকায় একাধিক বাড়ি এবং ফ্ল্যাট
ছাড়াও তাদের পরিবারের রয়েছে অঢেল সম্পদ। সুহৃদ ছাড়াও আইসসহ গ্রেফতার হন বাড্ডার হোসেন
মার্কেটের মালিকের ছেলে রহিত। তিনি মালয়েশিয়া থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। ধানমন্ডি থেকে
গ্রেফতার হন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইভান।
ঢাকায় আইস ছড়িয়ে পড়ার একেবারে শুরুর দিকে
একাধিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী
হাসান। তিনি বলেন, আইস হচ্ছে ‘পার্টি ড্রাগ’। এটি সব সময়
কয়েকজন মিলে গ্রুপে সেবন করা হয়। ফলে হাই সোসাইটির পার্টি সংস্কৃতির মধ্যে আইস সহজেই
ঢুকে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, আইস সেবনে বেশি পরিমাণে এনার্জি পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এছাড়া
বিদেশি সিনেমা ও সিরিয়াল দেখেও অনেকে আইসের মতো ভয়াবহ নেশার জগতে পা বাড়াচ্ছে। বিশেষ
করে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ নামের একটি বিদেশি
সিরিয়াল দেখে আইসসেবনে প্রলুব্ধ হচ্ছে অনেকে।
অ্যাপস গ্রুপে কেনাবেচা: সূত্র বলছে,
আইস পার্টি অনুষ্ঠিত হয় কঠোর গোপনীয়তায়। বিশেষ লিংক ছাড়া আইস পার্টিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ
নেই। অর্থাৎ বন্ধুর পরিচিত বন্ধু এবং তার বন্ধু-এভাবে বাছাই করা লোক নিয়ে আসর বসে।
গোপনীয়তা বজায় রাখতে পার্টির স্থান, টাইম প্রভৃতি সম্পর্কে কথাবার্তা হয় অ্যাপচ্যাট
নামের বিশেষ অ্যাপে। এতে যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়। ফলে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কেউ গ্রেফতার হলেও চক্রের অন্য সদস্যদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া
যায় না।
এছাড়া আইসের বেচাকেনা হচ্ছে টেলিগ্রাম
এবং হোয়াটসঅ্যাপসহ বেশ কয়েকটি এনক্রিপ্টেড অ্যাপে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে আইস
পার্টির আয়োজন হচ্ছে অভিজাত এলাকা গুলশান, ধানমন্ডি ও বারিধারায়। এছাড়া ভাটারা এলাকার
একটি বৃহৎ আবাসিক এলাকায় বসছে আইস পার্টি। মাদকসেবনের কার্যক্রম শুরু হয় গভীর রাতে,
চলে শেষ রাত অবধি। আইস পার্টি করতে গভীর রাতে অনেকে গাড়িবহর নিয়ে ছুটছেন ঢাকা মাওয়া
এক্সপ্রেস রোডে।
সূত্র বলছে, রাজধানীতে আইস চক্রে জড়িত
সন্দেহে অন্তত ৩০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। কেউ
কেউ আছেন শোবিজ জগতের গ্ল্যামার গার্ল। এর মধ্যে গুলশান এলাকায় আইসের প্রধান ডিলার
হিসাবে জাবির খান নামের এক ধনাঢ্য যুবককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিপ্তরের গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক সামসুল কবির যুগান্তরকে বলেন, জাবির খানকে ধরতে
পারলে রাজধানীর আইস নেটওয়ার্ক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। তাকে ধরতে ইতোমধ্যে
কয়েক দফা অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তিনি পলাতক। তবে অচিরেই তিনি ধরা পড়বেন।
সূত্র বলছে, প্রযুক্তির সহায়তায় কথোপকথনের
সূত্র ধরে রাজধানীতে আইস চক্রের সদস্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ইয়াসির, রাসেল ও উর্মিলা
নামের এক তরুণীকে। এছাড়া গুলশানের আইস পার্টিতে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে এমন বেশ কয়েকজন
তরুণীর ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। এদের মধ্যে আজমিন সারিকা, পুনম, ম্যাকরনা আলম, আমান
এশা ও ইডেন ডি সিলভা অন্যতম। আইস পার্টির গডফাদারের ভূমিকায় আছেন গুলশানের বাসিন্দা
জায়েদ। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা এলাকায় প্রাইভেট আইস পার্টির আয়োজক হিসাবে নারকোটিক্সের
নজরদারিতে আছেন এক শ্রীলংকান তরুণী। অন্তত ৬ মাস তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। জান্নাত
ওরফে ইমু নামে এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর মাধ্যমে আইস নেটওয়ার্ক চালাচ্ছেন তিনি।
লুফে নিচ্ছে ইয়াবার বাজার: দিনদিন আইসের
বিস্তার বাড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আইসপ্রবণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে
চিহ্নিত করা হয়েছে। আইস ছড়াচ্ছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। বনানী এলাকার
কয়েকটি সিসা লাউঞ্জ আইস পার্টির পিকআপ পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বনানীর আল গিসিনো,
ঢাকা ক্যাফে, টিজিএস এবং কিউডিএস সিসা লাউঞ্জে আড্ডা শেষে আইস পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন
অনেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দেশে ব্যবহৃত মাদকের ৪৫ শতাংশ ইয়াবার দখলে।
বাকিটা হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদসহ বিভিন্ন নেশা উপকরণ। তবে ধীরে ধীরে ইয়াবার বাজার
চলে যাচ্ছে আইসের দখলে। এক বছরের মধ্যে হয়তো ইয়াবার বাজার পুরোটাই আইসের দখলে চলে যাবে
বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক
সুমনুর রহমান বলেন, মাদক হিসাবে ‘আইস’ হালের ক্রেজ।
মাদক বিস্তারের ক্রমধারা বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যায় অল্পদিনের মধ্যেই হয়তো এটি ইয়াবার
স্থলাভিষিক্ত হবে। কারণ একসময় দেশে হেরোইনের বিস্তার ছিল। এরপর মহা ধুমধামে আসে ফেনসিডিল।
ফেনসিডিলের চাপে হেরোইনের বাজার কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আবার ইয়াবার বিস্তার শুরু
হলে ফেনসিডিলের বাজার সীমিত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে আইসের বিস্তার বাড়ছে। একপর্যায়ে
হয়তো ইয়াবার বাজার পুরোটাই আইসের দখলে চলে যাবে। এজন্য এখনই আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক
হতে হবে। আইসের ক্রমবর্ধমান বিস্তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের
বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের (ঢাকা) সহকারী পরিচালক রিফাত হোসেন বলেন, মাদকের
জগতে নেশাগ্রস্তরা নিত্যনতুন মাদকের সন্ধান করে। কারণ একটি মাদক নিতে নিতে দেহে সহনশীলতা
তৈরি হয়। তখন পুরোনো মাদকে নেশা হয় না। এ কারণে আগে যারা দীর্ঘদিন ইয়াবা নিতেন, এখন
তাদের অনেকেই আইসের দিকে ঝুঁকছেন। এছাড়া ধানাঢ্য শ্রেণির অনেকেই ক্রেজ সৃষ্টির জন্য
আইসের দিকে ঝুঁকছে। অভিজাত শ্রেণির কেউ কেউ আবার বিকৃত রুচি থেকেও জড়িয়ে পড়ছেন আইসের
নেশায়।