বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার লিখিত রায়ে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে মামলা না নিতে পুলিশকে নির্দেশনার কোনো উল্লেখ নেই। চার বছর আগে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১১ নভেম্বর রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর তৎকালীন বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার।
রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেওয়া হয়।
খালাস পাওয়া পাঁচজন হলেন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ, তাঁর বন্ধু সাদমান
সাকিফ, নাঈম আশরাফ, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
রায়ের পর কৌঁসুলিদের উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, রায় ঘোষণার সময় বিচারক নির্দেশনা দিয়েছেন যে ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়। এমন নির্দেশনার খবর প্রকাশিত হলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা বলেন, এই নির্দেশনা সংবিধান ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী।
এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে গত শনিবার ওই বিচারকের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, বিচারকের রায়ের
বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলতে চান না। তবে ওই বিচারকের পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক।
এ কারণে তিনি গত রোববার প্রধান বিচারপতির কাছে বিচারক হিসেবে তাঁর (মোছা. কামরুন্নাহার)
দায়িত্ব পালন নিয়ে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে জন্য একটা চিঠি লেখার কথা বলেন। এরপর
রোববার প্রধান বিচারপতি ওই বিচারককে আদালতে না বসতে নির্দেশ দেন। পরে তাঁকে ট্রাইব্যুনাল
থেকে প্রত্যাহার করে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।
ইংরেজিতে লেখা ৫৪ পৃষ্ঠার লিখিত রায়ে ধর্ষণের
অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়, সে–সংক্রান্ত কোনো
নির্দেশনা বা পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়নি। তবে লিখিত রায়ে ৭২ ঘণ্টার প্রসঙ্গ এনেছেন মোছা.
কামরুন্নাহার। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
রায়ে বিচারক লিখেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল
বহু ধর্ষণ মামলা দেখেছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ও যৌনজীবনে অভ্যস্ত নারী বিচারের জন্য আসেন,
যেখানে কথিত অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অনেক দিন পর তাঁদের মেডিকেল পরীক্ষা হয়েছে। অনেক দিন
পর মামলা হলে যৌন সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। মামলা করার সময় যদি বিষয়টি দেখা হয়,
৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি মেডিকেল পরীক্ষা করা হয় (যেমনটি বহু মামলায় চিকিৎসকেরা মতামত দিয়েছেন)
এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ধর্ষণ মামলায় তা গুরুত্বপূর্ণ নথি
বলে গণ্য হয়। তখন ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার নিশ্চিত করা যায় এবং ন্যায়বিচার
সর্বোত্তমভাবে করা সম্ভব হয়।
রায়ে বিচারক লিখেছেন, প্রাপ্তবয়স্ক বাদীদের
যদি ঘটনার পরপর বা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা হতো, তাহলে ধর্ষণের চিহ্ন
বাদীদের পক্ষে যেত। এমনকি তাঁরা যদি পরদিন অথবা ঘটনার পরপর মামলা করতেন, তাহলে পুলিশ
যৌন সহিংসতার কারণে আঘাতের চিহ্ন তাঁদের মুখে, গালে বা শরীরের অন্য কোথাও পেত।
মামলাটি সম্পর্কে মোছা. কামরুন্নাহার লিখেছেন,
৩৮ দিন পর মামলা হওয়া ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত
হওয়া যায়নি।
সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার
প্রসঙ্গও এসেছে লিখিত রায়ে। বিচারক রায়ে লিখেছেন, বাদীরা মামলা করতে যাননি; বরং পিয়াসা
তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে যান তাঁর সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করাতে। বিষয়টি এ মামলাকে
সাজানো মামলায় পরিণত করে। বাদীপক্ষ যে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছে, তা অসংগতি ও অসামঞ্জস্যতায়
পূর্ণ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণকে বিশ্বাসযোগ্য করে না। এমন সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যহীন, যা মামলাটির
শিকড়ে আঘাত করেছে। সংশয় তৈরি করেছে।
বিচারক লিখেছেন, বাদীরা সংশয়ের ঊর্ধ্বে
মামলাটিকে প্রতিষ্ঠায় হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিচারক তাঁর রায়ে লিখেছেন, সাফাত ও নাঈম
৯(১) ধারায় অপরাধ করেছেন কি না, অন্য তিন আসামি সাদমান সাকিফ, মো. বিল্লাল হোসেন ও
রহমত আলী ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগিতা করেছেন কি না, বাদীরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারলেন কি না—এ তিন বিষয় তিনি
বিবেচনা করেছেন।
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটি তদন্ত করে একই বছরের ৮ জুন পুলিশ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। পাঁচ আসামিই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে তাঁরা আদালতকে বলেন, পুলিশ ভয় দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেছিল।