
দ্বীপজেলার
ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত মহিষের দুধের কাঁচা দধি। এটা ভোলার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য
বহন করে। এখানকার অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপাদন এটি। এ টক দধি গুড়, মিষ্টি অথবা চিনি
দিয়ে খাওয়া যায়। দধি সব সামাজিক, পারিবারিক ও ঘরোয়া ভোজে থাকতেই হবে। এ ছাড়া খাবার
হজমে কাঁচা দুধের দধি বাড়তি সহায়তা করায় এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
স্থানীয়রা খাবারের
শেষে ভাতের সঙ্গে দই খায়। দই-চিড়ার সঙ্গে হালকা মুড়ি ও চিনি মিশিয়ে মজা করে খাওয়া যায়।
গরমের মৌসুমে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে ঘোল তৈরি করা হয়। এ ঘোল গরমের দিনে
মানবদেহকে ঠাণ্ডা রাখে। অনেকে কুটুম বাড়িসহ দ‚র-দ‚রান্তের পছন্দের মানুষের উপহার কিংবা দেশের বাইরেও প্রিয়জনদের কাছে এখানকার
দধি পাঠান অনেকে। তথ্য মতে, দইয়ে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপদান রয়েছে,
যা আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারী।
বোরহানউদ্দিন
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ আবুল কালাম বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে ভোলার
উৎপত্তি। এখানে ক্রমবর্ধমান হারে জনবসতি গড়ে ওঠে। উপার্জনের জন্য তারা মহিষ, গরু, ছাগল
পালন শুরু করে। বিশেষ করে গৃহস্থ পরিবারগুলো শত শত মহিষ প্রতিপালন করে। এখানে কোনো
বিয়ের অনুষ্ঠান হলে দধি দিয়ে আপ্যায়ন করা যেন বাধ্যতামূলক। শীতে হাঁসের মাংসের সঙ্গে
টক দধি আর খেঁজুরের গুড় ভোজন রসিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় খাবার।
বোরহানউদ্দিন
সরকারি আব্দুল জব্বার কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবুল কাসেম বলেন, মেঘনা-তেতুলিয়া নদীতে
অনেক চর রয়েছে। বিস্তীর্ণ এসব চরাঞ্চলে লালন করা হয় শত শত মহিষ। যুগ যুগ ধরে বহু পরিবার
এখানে মহিষ ও দধি বিক্রির পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। দুধ-দধির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন
চরে গড়ে উঠেছে শত শত মহিষ বাথান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব বাথান থেকে মণে মণে দুধ
আসতে শুরু করে শহরের বাজারগুলোয়।ওখান থেকে গোয়ালরা তাদের প্রয়োজন মতো দুধ কিনে নেন।
এরপর বিভিন্ন ধরনের টালিতে দুধ বসিয়ে দই প্রস্তুত
করেন।
দধির কারিগর
কালু, কমল, বিষ্ঞু জানান, বাপ-দাদা থেকে বংশ পরম্পরায় আমরা এ ব্যবসা করছি। তারা জানান,
জয়া, সাকের ভিটা, দরুন বাজারসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের দুধ এনে থাকি। তিনি জানান, ১ কেজি
দধির দাম ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা বেচাকেনা হয়। দুধের দাম কমলে দধিরও দাম কমে। উপজেলার সব
হাট-বাজারে দধির দোকানে বিক্রি হয় মহিষের দুধের দধি। পৌরবাজারের দধি বিক্রেতা নজরুল
ইসলাম, অজুদ বেপারী, মন্নান, ইমরান বলেন, সারাদেশের মধ্যে একসময় এই এলাকার দধিরই কদর
ছিল। তারা বলেন, মহিষের দুধের দধি তৈরিতে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। শুধু কাঁচা দুধটা
ছেঁকে মাটির পাত্রটি (টালি) পরিষ্কার করে তাতে দুধ ঢেলে বসিয়ে দিলেই ১৮-২০ ঘণ্টার মধ্যে
দধি হয়ে যায়। খাঁটি দুধ পাওয়া মুশকিল। ভোলার মহিষের একবার দধি খেলে তার স্বাদ আর ভুলতে
পারবে না।
দুধ বিক্রেতা
মাইনুদ্দিন জানান, প্রতিদিন ছমিরউদ্দিন, খাজুরগাছিয়া ও শ্রীনাথ চরের বাথান থেকে ১০-১২
মণ দুধ এনে উপজেলার গোয়ালদের মাঝে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি দুধ ১০০ টাকা দামে বিক্রি
করা হয়। শাহিন বলেন, আজকে সিকদারের চর থেকে ৩০ কেজি দুধ আনছি। ১০০ টাকা কেজি করে ৮
জনের কাছে বিক্রি করছি। মহিষগুলো বাচ্চা দিবে তাই দুধের পরিমাণ কমছে।
নজরুল দধি ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী নজরুল, অদুদ বেপারী জানান, মহিষের খাঁটি দুধ দিয়ে দধি তৈরি হয়। এর মধ্যে কোনো ধরনের ভেজাল নেই। এ দুধ অনেক ঘন। তাই স্বাদ বেশি। এ দধিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল নেই। মহিষ বাথানের মালিক ও গংগাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রেজাউল করিম রিয়াজ বলেন, চরলতিফ, বয়ারচর, পাতার চরে মহিষের বাথান আছে। আমার ১১১টি মহিষ আছে।
এ ছাড়া স্বপন
চেয়ারম্যান, অহিদ সর্দার, দেলু হায়দার, কয়ছরের বাথান আছে। সমস্ত চরে হাজার খানেক মহিষ
আছে। দৈনিক এখান থেকে ২৩০ থেকে ২৫০ কেজি দুধ হয়। জেলায় অনেকেই ঐতিহ্য ধারণ করে মহিষ
পালন করে আসছেন, যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে
এসব প্রাণীর নিরাপত্তার জন্য চরে কিল্লা স্থাপনের প্রয়োজন বলে মনে করেন। তবে উপজেলা
প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কে,
এম আসাদুজ্জামান বলেন, বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ১৩ হাজার, ২৯৮টি মহিষ আছে।
গ্রামীণ জন
উন্নয়ন সংস্থার এসইপি প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. তরুন কুমার পাল জানান, কেবল
মহিষ ও মহিষ বাথানিয়াদের কথা চিন্তা করে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সাথে রয়েছে
বিনামূল্যে মহিষের চিকিৎসাসেবা।
পল্লীকর্ম-সহায়ক
ফাউন্ডেশনের এসইপি প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা ভোলার ভেদুরিয়ার চর চটকি
মারা, ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চর চন্দ্র প্রসাদ ও চরমুন্সিতে মোট তিনটি আধুনিক কিল্লা নির্মাণ
কাজ সম্পন্ন করেন। যা ভোলাতেই প্রথম বলে জানান গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী
পরিচালক জাকির হোসেন মহিন। গুরুত্ব বিবেচনায় আরও কিল্লা নির্মাণ কাজটি চলমান থাকবে
বলে জানান তিনি।
বোরহানউদ্দিন
উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান বলেন, ইলিশ আর মহিষের দুধের কাঁচা দধি
ভোলার ব্র্যান্ড। উপকূলের মহিষের দুধে আছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো
মহিষের দুধভিত্তিক কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের
সুযোগ তৈরি হতে পারে। ঐতিহ্যবাহী এ পণ্যের সুনাম ছড়াতে পারে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও।