ছয় ঋতুর এই দেশে পৌষ ও মাঘ দুই মাস শীতকাল
হলেও প্রকৃতিতে শীত হাজির হয় আরো আগে থেকেই। বাঙলা মাসের তারিখের হিসাবে এখনও শীত আসেনি।
কিন্তু গ্রাম থেকে নগর, সব জায়গায়ই চলছে শীতের আয়োজন। দখিণের মেঠোপথ এখন হালকা শিশির
ভেজা ঘাসে, আমনের ক্ষেতে সকালের নরম রোদ, আর আবছা কুয়াশার জাল ঘেরা সকাল-সন্ধ্যার রহস্য।
সন্ধ্যার পর হাত বাড়ালেই বরিশাল নগরীর
ফুটপাতে ভাপা, পাটিসাপটাসহ শীতের নানা পিঠাপুলি পাওয়া যায়। আর শীতের সবজি আসতে শুরু
করেছে অনেক আগেই। এদিকে প্রকৃতির সাথে তালমিলিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করার জন্য প্রস্তুতি
নিচ্ছেন গাছিরা।
ইতিমধ্যে খেজুর গাছ চাঁছতে (স্থানীয় শব্দ-
ঝোড়া) শুরু করেছেন। গাছের মূল অংশে প্রলেপ দেয়া শেষ হলে শুরু হবে শুকানোর পালা। এরপর
রেখা কেটে নল লাগানো শেষে রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করা হয়। হিসাবমতে আরও দুইসপ্তাহ
পর খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে পারবে গাছিরা। খেজুর গাছ একবার চাঁছলে তিন-চার দিন
রস সংগ্রহ করা যায়। তারপর আবার তিনদিন গাছ শুকাতে হয়। শুকনো গাছের রস সুমিষ্ট হয়। যত
শীত বাড়বে, তত খেজুরের রস সংগ্রহ হবে। খেজুরের রস সংগ্রহ চলবে পুরো শীত জুড়ে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঝালকাঠি-বরিশাল
ও বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের পাশে কয়েক হাজার খেজুর গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত
করছেন গাছিরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছিরা খেজুরের গাছগুলো পরিচর্যা করছেন। ঝুঁকি
নিয়ে মাজায় ফিতা বেধেঁ করছেন গাছ ছাটাইয়ের কাজ।
এদিকে গাছিরা বলছেন, ক্রমশই খেজুরের গাছের
সংখ্যা কমে যাচ্ছে। একসময় এ অঞ্চলের বাড়ির আঙিনায় খেজুরের গাছ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ
সৌন্দর্য ছিল। ঝোপঝাড়ে, ক্ষেতের আইলে, গ্রামের মেঠোপথের দুই ধারে অসংখ্য খেজুরের গাছ
কোন পরিচর্যা ছাড়া বড় হতো। এখন আর তা দেখা যায় না।
জনপদের সাধারণ মানুষ সচেতন না হওয়ার কারণে
পরিবেশবান্ধব এ খেজুরের গাছ ইট ভাটায় জ্বালানি হিসাবে বেশি ব্যবহার করার কারণে খেজুর
গাছ চোখে পড়ে না। কমছে শুধুই খেজুর গাছের সংখ্যা। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের
জীবন-যাপন। হারিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রচলিত সংস্কৃতি।
বরিশালের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় গ্রামীন
মাঠে আর মেঠোপথের ধারে কিছু খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসাবে, গ্রামগুলোতে
জীব বৈচিত্রের সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়নে বন বিভাগের সচেতনতার অভাবে এসব
অঞ্চলে খেজুর গাছ অনেকটা বিলুপ্তির পথে।
গাছিরা বলছেন, জ্বালানি কাঠ ও কয়লা আপেক্ষা
খেজুর গাছ সস্তা দামে পাওয়া যায় বলে ইট ভাটায় এর চাহিদা বেশি। সেজন্যই প্রায় খেজুরের
গাছই কেঁটে ফেলা হয়েছে। কেননা, খেজুরের গাছে পোড়ানো ইটের রং গাঢ় হয়।
বরিশাল সরকারী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী রাব্বী ইসলাম বলেন, ‘আগের মতো গ্রাম্য
রাস্তার দু’পাশে সারি সারি
খেজুর গাছ আর নেই। গ্রামের রাস্তা গুলো সংস্কার ও নতুন করে খেজুর গাছ রোপনে মানুষের
আগ্রহের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।’
সচেতন মহল মনে করেন, খেজুর গাছ আমাদের
অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের
রক্ষা করতে হবে।